শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩২ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কমিটির আগে জানেন না বিএনপির সিনিয়ররা

কমিটির আগে জানেন না বিএনপির সিনিয়ররা

স্বদেশ ডেস্ক:

বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এক সময় সিনিয়র নেতাদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হতো। তাদের মতামতের ভিত্তিতে সাজানো হতো কমিটি। এ ক্ষেত্রে ভোটাভুটির মাধ্যমে কমিটি গঠন না হলেও অধিকাংশের মতামত আমলে নেওয়া হতো। গত কয়েক বছর ধরে এখন সিনিয়রদের মতামত নেওয়া তো হয়-ই না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতাদের এলাকায় কমিটি হলেও তারা জানতেই পারেন না। কমিটি গঠনের পর জানতে পারেন।

কমিটি গঠনের এমন ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অসহায় বোধ করছেন দলটির নীতিনির্ধারক ও সিনিয়র নেতারা। ফলে স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যানসহ অনেক নেতার মধ্যে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমের প্রতি আগ্রহ কমেছে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, প্রথমত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি না করে পকেট কমিটি করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত কমিটি গঠনের আগে তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ফলে কমিটি গঠনে অনেক নিষ্ক্রিয় এবং সিনিয়র নেতাদের সম্মান করে না- এমন লোকও তাদের নির্বাচনী এলাকার কমিটিতে আসছে। এসব কারণে তাদের এলাকার রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থাকায় দৃশ্যমান কোনো প্রতিক্রিয়াও এসব সিনিয়র নেতা দেখাতে পারছেন না। করোনা পরিস্থিতির কারণে আপাতত বিএনপির কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া স্থগিত থাকলেও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠন জোরেশোরে চলছে। বিএনপির তৃণমূল কমিটি গঠন বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে বলে বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানান।

চলতি মাসে এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির কয়েক নেতা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও তারেক রহমানের উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানেও প্রস্তাব করা হয়, মানসম্মানের কথা চিন্তা করে অন্তত স্থায়ী কমিটির নেতাদের নির্বাচনী এলাকাগুলোয় যেন তাদের মতো করে কমিটিগুলো করা হয়।

স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে নেতারা একমত পোষণ করেন দল পুনর্গঠনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার। কিন্তু তারও কোনো আলামত তৃণমূলের কমিটি গঠনে দেখতে পাচ্ছেন না সিনিয়র নেতারা। সম্প্রতি, দলের মহাসচিব মির্র্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সদ্য প্রয়াত আবদুল মান্নানের ভার্চুয়াল স্মরণসভায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোতে যারা কাজ করছি, নেতৃত্বে আছি, সহযোগিতা করছি সেখানে কিন্তু গণতান্ত্রিক চর্চা আমাদেরই আনতে হবে। আমরা সমাজ চাইব গণতান্ত্রিক, রাষ্ট্রব্যবস্থা চাইব গণতান্ত্রিক কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিকভাবে বিনির্মাণ করব না- এটা হতে পারে না। গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্মাণ করি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো বড় উপকরণ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করার।

বিচার বিভাগ, আদালত, প্রশাসন, জাতীয় সংসদ, রাজনৈতিক দল সব প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোই তো দেশ চালায়। আরও উদ্যোগী হতে হবে।

স্থায়ী কমিটির এক নেতা আক্ষেপ করে বলেন, এখন অবস্থা এমন পর্যায় গেছে এলাকার রাজনীতিতে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি মোটা হয়ে গেছে। অনেক সিনিয়র নেতাকেও তাদের নির্বাচনী এলাকার কমিটি গঠন বিষয়ে বিএনপির জুনিয়রদের পেছনে ঘুরতে হচ্ছে। ওইসব জুনিয়ররাও বিষয়টি বেশ উপভোগ করছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা তো পাত্তাই দিচ্ছেন না। তাদের কোনো কথা বললে ‘ভাইয়ার’ নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন বলে মুখের ওপর বলে দেন। এভাবে চলতে থাকলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে- যা দলের জন্য বড় ধরনের অমঙ্গল বয়ে আনবে। কেউ কেউ মানসম্মানের কথা চিন্তা করে দল থেকে বিদায় নেওয়ারও চিন্তা করছেন।

স্থায়ী কমিটি ও ভাইস চেয়ারম্যান পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, বিএনপির জেলা, উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠনের দায়িত্বে রয়েছেন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসাংগঠন সম্পাদক পর্যায়ের নেতারা। কোথাও কোথাও যুগ্ম মহাসচিবদেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সংগঠন যুবদল ও সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের নেতৃত্বে একাধিক বিভাগীয় টিম রয়েছে। পুনর্গঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সঙ্গত কারণেই কমিটি গঠন বিষয়ে যাবতীয় নির্দেশনা দেন তিনি। কিন্তু যারা এসব কমিটি গঠনের দায়িত্বে আছেন তাদের অনেকেই নিরপেক্ষ নন। ইতোমধ্যে যুবদল ও ছাত্রদলের টিমের বিরুদ্ধে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে কোনো কোনো নেতার পক্ষ নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এ পদ্ধতি চালুর পর বিএনপিও তার গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনেছে। আমি মনে করি দলের কমিটি গঠনে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার নিবেদিত সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়েই কমিটি করা উচিত।

তবে বিএনপি অথবা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমনও কমিটি আছে গত ২০-২৫ বছর ধরে হয়নি। কোথাও কোথাও কমিটিই নেই। এসব কারণে স্থানীয় রাজনীতিতে এক ধরনের বন্ধ্যত্ব তৈরি হয়েছে। যার কারণে অভিযোগ একটু বেশি হচ্ছে। কারণ পদ আছে দুটি। সেখানে প্রার্থী আছেন ১০-১৫ জন। দুজনকে সন্তুষ্ট করা গেলেও বাকিরা তো নানা অভিযোগ তুলবেই। আবার যারা টিমের সদস্য আছেন তাদের কথা বলার ধরনের কারণেও সিনিয়র নেতাদের কাছে তারেক রহমান সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে বলে মনে করেন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

জানতে চাইলে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু আমাদের সময়কে বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন কীভাবে কমিটি করতে হবে। তিনি সবাইকে স¥রণ করিয়ে দিয়েছেন বিএনপি একটি পরিবার। এ পরিবারকে শক্তিশালী করতে হবে। অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠনে বিএনপির মতামত নিয়েই গ্রহণযোগ্য কমিটি করতে হবে। তারপরও কমিটি গঠনে যেসব অভিযোগ আসছে তা আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করছি।

যুবদলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেন, এখন যেসব কমিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে করা হচ্ছে তা আহ্বায়ক কমিটি। আগামী তিন মাসের মধ্যে এসব কমিটি ভোটাভুটির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঢাকার এক প্রভাবশালী নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার নির্বাচনী এলাকার কয়েকটি ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। দীর্ঘদিন ধরে তিনি রাজনীতি করছেন, কিন্তু এমন ঘটনা আগে কখনো দেখেননি। এ সময় তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আরও দুই স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, তাদের নির্বাচনী এলাকায়ও একই ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সাংগঠনিক জেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ইউনিটে কমিটি ঘোষণা করে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনগুলো। এসব কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও জানানো হয়েছে। বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, অঙ্গ সংগঠনের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদীয় আসনের যিনি সর্বশেষ প্রার্থী ছিলেন এবং বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অবশ্যই মতামত নিতে হবে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানেরও নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ আমরা পেয়েছি- এটা সত্য। এসব অভিযোগ হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগরের কাফরুল থানা যুবদলের সভাপতি শরিফুল ইসলাম মিলনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতারা ক্ষোভ জানিয়েছেন। শরিফুল ইসলাম মিলন বলেন, আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারের পেছনে কারও ইন্ধন থাকতে পারে। অথচ করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এ প্রার্দুভাবের মধ্যেও মাঠে থেকে দলের জন্য কাজ করেছি। এ সময় প্রায় ১৭ হাজার মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি দলের হয়ে ২৩ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি। কাফরুল থানা যুবদলে ২ বছর ধরে সভাপতি হিসেবে কাজ করেছি। এর আগে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের ২১টি ও দক্ষিণের ২৪ থানা কমিটি গঠন করা হয়েছে। অধিকাংশ থানা কমিটি গঠনে স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রার্থীদের ও বিএনপি নেতাদের কোনো মতামত নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এ নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কথাও বলেছেন। এমনকি এসব কমিটি গঠন বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সদ্য প্রয়াত শফিউল বারী বাবুকেও অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। শফিউল বারী বাবুকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি করা হচ্ছে গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশের পর তাকে দলের একটি অংশ চাপে রাখে। তিনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন এ কমিটি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কমিটি গঠনের পরপরই তা বাতিলের দাবিতে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছে থানাগুলোর নেতাকর্মী। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ এনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে চিঠিও দিয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877